উবাইদুল্লাহ জাফরঃ একদল কিশোর খেলাধুলা করছিল। সবার বয়স ছয় কি সাতের কোঠায়। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন একজন ফকির দরবেশ। কিশোরদের দেখে দাঁড়ালেন। একজনকে ইঙ্গিত করে বললেন, তোমাদের মধ্যে এই ছেলেটি একদিন রাজা হবে। শোনো ছেলে— যখন তুমি রাজা হবে, এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করবে।
দরবেশ চলে গেলেন। কিশোরেরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে পুনরায় খেলতে লাগল।
১.
ছেলেটির নাম ফাতাহ মুহাম্মদ। পিতা হায়দার আলী ছিলেন মহিসুরের সেনাবাহিনীর একজন সাধারণ কর্মকর্তা। কিন্তু ছেলের প্রতি ছিলো তার গভীর মনোযোগ। ছেলের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে তার দৃষ্টি ছিলো সর্বদাই সজাগ। ছেলেকে তিনি গড়ে তুলবেন জ্ঞানে বলে যোগ্যতায়— এক মহান মানুষ হিশেবে।
সেনাবাহিনীর সাধারণ কর্মকর্তা থেকে নিজ যোগ্যতা আর কৌশলে হায়দার আলী হয়ে ওঠেন মহিসুরের সেনাপ্রধান। কালপরিক্রমায় নিজ হাতে তুলে নিতে হয় রাজ্যের শাসনভার। শুরু থেকেই তিনি লড়ে আসছিলেন ইংরেজ ও মারাঠাদের বিরুদ্ধে। এবার তা আরো জোরদার হয়। যুদ্ধের মধ্যে একদিন বেজে ওঠে হায়দার আলীর জীবনঘন্টা।
২.
১৭৫০ সালের ১০ই নভেম্বর শনিবার ফাতাহ মুহাম্মদের জন্ম।
তখন তাঁর যৌবনের পুরো বসন্ত। পিতার সাথে রাষ্ট্রের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় তাকেও। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে হয় ইংরেজদের বিরুদ্ধে। এরমধ্যে কথা উঠলো ফাতাহ মুহাম্মদের বিয়ে নিয়ে। বাবা পছন্দ করলেন এক মেয়েকে, মা করলেন আরেকজনকে— দুজনের পছন্দ রক্ষা করতে গিয়ে ফাতাহ মুহাম্মদ বিয়ে করলেন দুজনকেই—এক বৈঠকে। একঘণ্টা আগে-পরে।
১৮৮২ সাল। রাজ্যে তখন যুদ্ধ-পরিস্থিতি বিরাজমান। পিতার নির্দেশে বিদ্রোহ দমনে ফাতাহ মুহাম্মদ তখন মালাবারে। এরমধ্যেই একদিন পিতার ইন্তেকালের খবর আসে। রাজ্যের শাসনভার নিজ হাতে তুলে নিতে হয় ফাতাহ মুহাম্মদকে।
সুলতান হবার পর ফাতাহ মুহাম্মদের যুদ্ধব্যস্ততা আরো বেড়ে যায়। দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে থাকেন ইংরেজ ও মারাঠাদের । ইংরেজ, মারাঠা এবং পাশের কিছু অঙ্গরাজ্য এক হয়ে লড়ছিলো সুলতানের বিরুদ্ধে। যুদ্ধের পর যুদ্ধ আর দুশমনদের নানামুখী ষড়যন্ত্রের মুখেও রাজ্যজুড়ে তিনি কায়েম করেছিলেন ইনসাফ ও সম্প্রীতির নিদর্শন। ধনসম্পদ আর প্রাচুর্যে ঠাসা ছিলো তাঁর রাজ্য। এত যুদ্ধব্যস্ত থাকার পরও তিনি নিয়ম করে প্রজাদের সুখ-দুঃখের কথাগুলো শুনতেন। বিচার সালিশ করতেন। দুহাত উজাড় করে সম্পদ বিলাতেন— দান সদকা করতেন।
সুলতান হবার পর ফাতাহ মুহাম্মদের স্মরণ হলো শৈশবের সেই ফকিরের কথা। প্রাসাদের একপাশে নির্মাণ করলেন দৃষ্টিনন্দিত সেই ‘মসজিদে আলা’ । কিন্তু বিপত্তি ঘটলো প্রথম নামাজ পড়ানো ব্যক্তি নিয়ে। সুলতান শর্ত দিয়েছেন— বালক হবার পর থেকে যার এক ওয়াক্ত ফরজ নামাজ কাজা হয়নি, সেই হবে আজকের ইমাম।
কিন্তু কেউ সামনে যান না। কত বড় বড় আলেম-ফকীহ-বুজুর্গ উপস্থিত— কারো পা নড়ে না, কেউ সাহস পান না এগিয়ে যেতে। একপর্যায়ে সুলতান নিজেই সামনে গেলেন। মুসল্লায় দাঁড়িয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! আমিই ‘সহিবে তারতীব’।
৩.
এই মহান সুলতান উসমানিয় খলিফা কর্তৃক সুলতানি সনদ লাভ করেছিলেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার শেষ সূর্যটুকু তিনিই ধরে রেখেছিলেন। যার দরুণ তিনি হয়েছিলেন ইংরেজদের একমাত্র পথের কাঁটা। এতসবের মধ্যেও মাত্র কয়েক বছরে মাত্র তেত্রিশটি গ্রাম থেকে তাঁর রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত হয় আশি হাজার বর্গমাইল। রাজ্যে নিরক্ষরতার হার কমাতে তিনি ‘জামিউল আজহার’ নামে শ্রীরঙ্গপত্তনামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। সেখানে দীন-দুনিয়া একসঙ্গে শিক্ষাদানের সুব্যবস্থা ছিলো। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উচ্চ বেতনে সবগুলো জ্ঞান-বিদ্যার বিশেষজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি। সামরিক রীতিনীতি ও যুদ্ধনীতির যাবতীয় পরিভাষা সম্বলিত গ্রন্থ ‘ফাতহুল মুজাহিদীন’ তিনিই সংকলন করান। রাজ্যের বিভিন্ন পয়েন্টে কারখানা স্থাপন করেন— যার দরুণ বেকারত্ব বহুলাংশে দূর হয়।
এভাবে চলে আসে ১৭৯৯ সাল। ইংরেজদের হীন অপচেষ্টায় কতিপয় গাদ্দারের কারণে ইংরেজদের দখলে চলে যেতে থাকে তাঁর সম্রাজ্য। একদিন যুদ্ধ অবস্থায় তিনি যখন বুঝতে পারেন, গাদ্দারীর শিকার হয়েছেন— দুই নলাবিশিষ্ট বন্দুক নিয়ে ঘোড়ায় চেপে বসেন। রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হন। লড়াই চালিয়ে যান। এসময় কেউ একজন তাকে বলেছিল, সুলতান! আত্মসমর্পণ করলেই তো হয়। ঠিক তখনই তাঁর পবিত্র যবানীতে উচ্চারিত হয় সেই বিখ্যাত উক্তি— শেয়ালের ন্যায় একশো বছর বেঁচে থাকার চাইতে সিংহের ন্যায় একদিন বেঁচে থাকা উত্তম— যা শত শত পরে আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
হিন্দুস্তানের দূর্ভাগ্যই বলতে হবে। সেদিন ময়দানে যুদ্ধাবস্থায় হঠাৎ একটি গুলি সুলতানের কানের লতা বরাবর বিদ্ধ হয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সুলতানের দেহ। সুলতানের নামে শুরুতে যুক্ত হয় ‘শহীদ’। ফাতাহ মুহাম্মদ শহীদ টিপু সুলতান। ভারতবর্ষ হারায় তার স্বাধীনতা। ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয় ন্যায় ও ইনসাফ, সাহস ও বীরত্বের নতুন এক নাম। মুসলিম ইতিহাসে যুক্ত হন আরেকজন সিপাহসালার সুলতান। ইতিহাস যাকে আখ্যায়িত করেছে মৃত্যুঞ্জয়ী মহাবীর ‘শহীদ টিপু সুলতান’ নামে।
গ্রন্থপঞ্জীঃ শহীদ টিপু সুলতান।
হা/১